শিরোনাম |
মেহেদীর সবুজ পাতার ভিতরে লাল রক্ত
"মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবণে
মানবের মাঝে আমি বাচিঁবারে চাই"
মোঃ লুৎফর রহমান শিক্ষক ও সাংবাদিক
|
![]() মেহেদীর সবুজ পাতার ভিতরে লাল রক্ত ১. খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে মহান শিক্ষক ও গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে এথেন্স নামক রাষ্ট্রের কিছু বকধার্মিকের প্রহসনের বিচারে দেয়া হয় মৃত্যুদন্ড! অভিযোগগুলো ছিল, অ্যাথেন্স রাষ্ট্রের দেবতাদেরকে তিনি স্বীকার করেন নি, অলৌকিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব দর্শন অনুসারে, এবং সক্রেটিসকে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সব অভিযোগ বিবেচনায় এনে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এখন ধরুন আমাদের দেশে অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের নাগরিকের কাছে দেবতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলবে, এগুলো অলৌকিক, অযুক্তিক, এবং ধর্মান্ধতার বিষয়। পৃথিবীর এমন অনেক জনপদ, ভূখণ্ড, দেশ, গোত্র, জাতি, আছে যাদের একে অপরের সাথে সংস্কৃতি, আচার, মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কারে অনেক অমিল দেখা যায়। তখনকার এথেন্স নামক রাষ্ট্রে যে শাসক গোষ্ঠী ছিল তা ধর্মীয় কুসংস্কার দ্বারা পরিচালিত হতো। সক্রেটিসের একটি বিশ্বাস ছিল এমন যে, কেউই সত্য জেনে ভুল করে না। মানুষের কাছে যা ভাল মনে হয়, তাই সে করে। সমাজ জানে চুরি করা মন্দ কাজ, কিন্তু একজন চোরের নিকট চুরি করাটা তার জীবন কিছুটা সহজ করার রাস্তা। তাই চোরের ধারণা চুরি করা ভাল কাজ এবং সে তা করে। আর এই ভুল ধারণা, সত্যে রুপান্তরিত করে কুসংস্কারে ঢেকে মানবতাকে নিষ্পেষিত করার কাজটি আনাদি কাল থেকেই চলছে। ২. ধর্ম এবং কুসংস্কার এতো শক্তিশালী, আসলে এ বিষয় গুলো কি? প্রথমতঃ সৎ কর্মই ধর্ম। কোন ধর্মে বলা হয়নি, তুমি খারাপ কাজ করো। দ্বিতীয়ঃত, মহামানবদের জীবন অনুসরণ করাও ধর্ম। যেমন, আমরা মোহাম্মদ (সঃ) জীবন অনুসরণ করি তাই আমরা মুসলিম। আর যারা যিশু খৃষ্টের জীবন অনুসরণ করে তারা খৃষ্টান। গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এরকম আরও অনেক সনাতন ধর্মালম্বী আছে যারা কোন না কোন মহামানবকে অনুসরণ করে আচার নির্ভর অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তৃতীয়ত্ব, পৃথিবীর প্রত্যেক বস্তুরই স্বধর্ম আছে। যেমন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, আগুন, পানি, সব কিছুরই নিজস্ব ধর্ম আছে। তেমনই সকল মানুষের একটা স্বধর্ম থাকার কথা ছিল, কিন্তু তা নেই। ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করে। "সর্ব ধর্মের মর্মকথা সবার উপরে মানবতা"। এটাই যদি সকল মানুষ একত্রে পালন করতো, তাহলে পৃথীবিতে মানবতার বিপর্যয় ঘটতো না। কুসংস্কার হলো অবিশ্বাস, যুক্তিহীন কোন কিছু। সভ্য, অর্ধসভ্য, অশিক্ষিত এবং শিশু মনেই কুসংস্কাকারের বাস। অর্থাৎ কোন ঘটনা সত্য কি মিথ্যা যাচাই করা হয় না বা যাচাই করার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন তার অভাব থেকে যায়। ছোটরেলায় আমাদের পিতা, -মাতা দাদা- দাদী ভূত, পেত, জিন পরীর গল্প শুনিয়ে কুসংস্কারের বীজ বপন করছে। বর্তমানে আমাদের মোড়ল, সমাজপতি এমনকি রাষ্ট্রপতিরা দেশে দেশে কিছু বিশ্বাসকে মানতে বাধ্য করছে। ঐ সমাজে সেটার সত্য মিথ্যার বিচার নাই, গুরুবাক্য শিরোধার্য্য। ভারত উপমাহদেশে এক সময় অনেক কুসংস্কার ছিল এবং এখনও কিছু আছে। সতীদাহপ্রথা ছিল অন্যতম। ১৮২৯ সালে ৪ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক আইন করে এই প্রথা রহিত করে । আইনে বলা হয়, যে কেউ সতীদাহে সহায়তা করবে, সে "অপরাধযুক্ত নরহত্যা " অপরাধে অপরাধী হইয়া দন্ডনীয় হইবে। তৎকালিন হিন্দু সমাজে স্বামী মারা গেলে বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হতো। কিন্তু যদি কোন লোকের একাধিক স্ত্রী থাকতো তার জন্য কি বিধান ছিলো সেটা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু অনুমেয়, বিধানটি ছিলো মানবতার এক রক্তক্ষরণ। আমাদের সমাজে যৌতুক প্রথা প্রচলিত আছে। পত্রিকা খুললে প্রতিনিয়ত এর ছোবলে কতো সবুজ সতেজ প্রান ঝরে যাচ্ছে। কেউ কি সঠিক খবর রাখতে পারচ্ছে। ৩. ইরানের 'নৈতিক পুলিশের' হেফাজতে ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু হয়। মাশা আমিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, হিজাব পরে থাকলেও তার কিছু চুল ঠিকই দেখা যাচ্ছিল। শরিয়া অনুসারী ইরানের আইনে বলা আছে, নারী তাদের চুল হিজাব দিয়ে ঢেকে রাখবে এবং লম্বা ঝুলের পোশাক পরবে। সেই সঙ্গে পোশাক হতে হবে ঢিলেঢালা, যেন তাদের শরীরের বাঁক স্পষ্ট না হয়ে ওঠে। বিবিসি লিখেছে, ইরানের এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে একবার তার অভিজ্ঞতা তাদের জানিয়েছিলেন। 'নারীকে সুরক্ষা দিতেই আমরা নৈতিক পুলিশে কাজ করছি এমনটাই বলা হয়েছিল আমাদের। কারণ নারী যদি ঢেকে রাখা পোশাক না পরে, তাহলে পুরুষ তাতে উত্তেজিত হবে এবং নারীর ক্ষতি করবে। পরিচয় গোপন রাখা এই পুলিশ বিবিসিকে জানান, বাহিনী থেকে প্রত্যাশা করা হতো, আমরা আটকদের জোর করে ভ্যানে তুলে দেবো । আপনি জানেন না, এমন করতে গিয়ে আমি কতবার কেঁদেছি। আমি বলতে চাই, আমি আসলে ওদের দলের নই। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই সাধারণ সৈনিক, যাদের বাধ্যতামূলকভাবে বাহিনীতে কাজ করতে হয়। আমার খুব খারাপ লাগে।' কঠোর হিজাব আইন এবং এর বাস্তবায়নকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর পোশাক নিয়ে কঠোর রক্ষণশীলতার রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়া নারীরা তাদের হিজাব, চুল, পুড়িয়ে এমনকি বিবস্ত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ইতোমধ্যে, কয়েক দিনের আন্দোলনে ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছে। ৪. সত্য এক হৃদয়বিদারক ঘটনাটি লিখেন একজন ইরানি লেখক। নাম, ফ্রিদৌনি সাহেবজাম। সময়, উনিশশো নব্বই সাল। বইটি ইরান ব্যান্ড করে দেয়। দুই হাজার আট সালে "দ্য স্টোনিং অফ সুরাইয়া এম" নামে সিনেমার তৈরি করা হয়। ঘটনাটি ছিল নিম্নোক্ত, ইরানের একটা ছোট্ট গ্রাম। ওখানে সুরাইয়ার সংসার। স্বামী, দুই কন্যা আর দুই পুত্র সন্তান। স্বামীর হঠাৎ নজর পড়ে চৌদ্দ বৎসর বয়সী এক কিশোরীর ওপর। তাকে বিয়ে করার আকাঙ্খা মাথায় চাপে। কিন্তু ঘরে স্ত্রী থাকতে আরেকটা বিয়ে করা ঝামেলা। খরচাপাতিও বেশী। তখন স্বামী ফন্দি আঁটে। গ্রামের সর্দারের সাথে বোঝাপড়া করে। এবং নিজের স্ত্রীর নামে গুজব রটিয়ে দেয়। গুজব হলো, স্ত্রীর একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে। গুজব শক্তিশালী করার জন্য হুমকি ধমকি দিয়ে সাক্ষীও জোগাড় করে। সুরাইয়ার অপরাধ প্রমাণিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী সুরাইয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডটা ভয়ানক। প্রকাশ্যে রাস্তায় গর্ত খোঁড়া হয়। সুরাইয়ার হাত পা বাঁধা হয়। গর্তে কোমর পর্যন্ত পোঁতা হয় তাকে। মাটি দিয়ে ভরাট করা হয় চারপাশ। তারপর দূর থেকে পাথর ছোঁড়া হয় শরীর উদ্দেশ্য করে। প্রথম পাথর ছুঁড়তে হয় সুরাইয়ার পিতাকেই। তারপর একেক করে সবাই। এমনকি সুরাইয়ার দুই পুত্রকেও জোর করে পাথর ছুঁড়তে বাধ্য করা হয় মায়ের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অনর্গল পাথর ছোঁড়ার পর সুরাইয়ার চারপাশের মাটি লাল হয়ে আসে, ছিঁটে ছিঁটে রক্ত পড়ে। শরীরের নাড়াচাড়া বন্ধ হয়। তখন স্বামী উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সুরাইয়ার রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা করে, সে বেঁচে আছে কিনা। সুরাইয়া বেঁচে ছিল অমন ক্ষত বিক্ষত হওয়ার পরও। চোখ খুলেছিল। তখনও মরেনি বুঝতে পেরে স্বামী সহ গ্রামের সবাই সুরাইয়ার আশপাশে পড়ে থাকা রক্তাক্ত পাথর কুড়িয়ে নিয়ে পুনরায় ছুঁড়তে শুরু করে। সুরাইয়ার মৃত্যু হয় অতঃপর। আজ আমার জানাতে ইচ্ছে করচ্ছে, সারা গা আবৃত করে চলাফেরা করা একটা দেশে এক মধ্যবয়সী নারীকে পুরো গ্রাম পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরে ফেলেছিল শুধুমাত্র একটা অপবাদ শুনে। যে অপবাদের এক ছটাক সত্যতাও ছিল না। ঐ নারীর মৃত্যুর আগে সম্মুখে দাঁড়িয়ে সবাই তামাশা দেখছিল। একটু লক্ষ করুন, শরিয়া আইন আর নৈতিক পুলিশ এই দুটির মধ্যে কেমন সাদৃশ্য। আইন হলো এমন নিয়ম- নীতি বা বিধি নিষেধ যা দ্বারা কোন কাজ করতে নিষেধ অথবা বাধ্য করা হয় জরিমানা অথবা কারাদন্ডের ভয় দেখিয়ে । আর নৈতিকতা হল স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে কোন কিছু গ্রহণ বা বর্জনকে বোঝায়। মনে করুন, আমাদের দেশে প্রকাশে নেশা করলে জেল/জরিমানার বিধান আছে এটি আইন। কিন্তু কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় নেশা ত্যাগ করে, এটা তার নৈতিকতা। জীব ও জীবনের তরে আমরা কি একটু মানবিক বা নৈতিক হতে পারিনা। ভূপেণ হাজারিকার বিখ্যাত গানের সুরে বলতে ইচ্ছে করে, ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন? বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের-হাহাকার শুনেও, নৈতিকতার স্খলন দেখেও –মানবতার পতন দেখেও- নির্লজ্জ অলস ভাবে বইছ কেন? জ্ঞানবিহীন নিরক্ষরের,খাদ্যবিহীন নাগরিকের নেতৃবিহীনতায় মৌন কেন? সহস্র বর্ষার- উন্মাদনার, মন্ত্র দিয়ে লক্ষজনেরে সবল সংগ্রামী, আর অগ্রগামী করে তোলো না কেন? নিঃশব্দে নীরবে- ও গঙ্গা তুমি (সবুজকে রক্তাক্ত করা) গঙ্গা বইছ কেন? |